মধ্যবিত্ত পরিবার অন্যসব পরিবার থেকে
পুরোপুরি আলাদা হয়। যেটা কমবেশি সবাই জানে।
আমার জন্ম ও ঠিক এক নিম্মধ্যবিত্ত পরিবারে।
আমার বাবা একজন কৃষক।
গ্রামে আমাদের একটা বাড়ি আছে।আর কিছু জমি
আছে যার ফসল দিয়ে আমাদের পরিবার চলত।
আমরা তিন ভাইবোন। আমি আমার বড় ভাই এবং
আমার ছোট বোন আর মা বাবা নিয়েই আমাদের
পরিবার। পরিবারের পাচ সদস্যের ভরনপোষনের
দায়িত্য আমার বাবার ঘাড়ে থাকলেও তিনি বেশিদিন
সেটা বইতে পারেন নি। খুব কষ্ট করতেন। তবুও
আমাদের তিন জনের লেখাপড়ার খরচ এবং সংসার
চালানে যেত না। তাই বাধ্য হয়ে বড় ভাই লেখাপড়া
ছেড়ে দেয় ।
তারপের বড় ভাই যায় কাজ করত তা দিয়ে আমাদের
দুজনের লেখাপড়া চলতো আর বাবার টাকা দিয়ে
সংসার।
এভাবে ভালোই কাটছিলো। কিন্তু হঠাৎ একদিন বাবা
অসুস্থ হয়ে পরলেন। বাবার দুটি পা প্যারালাইজড
হয়ে গেলো। যার ফলে বাবা কাজ করতে পারতেন না।
তাই পরিবারের সব দায়িত্ব বড় ভাইয়ের উপর
পরলো। যা তার পক্ষে নেওয়া সম্ভব ছিলো না।
তাই বাবা আমাকে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বললেন।
আর ক্ষেতে কাজ করতে বললেন। কিন্তু তখন আমি
সবে সমাপনী পরিক্ষা দিয়েছিলাম। তাই বাবাকে
বললামআমি: বাবা আমি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে
ভর্তি হতে চাই।
সেখানে তো টাকা লাগে না।।
আমাকে প্রাইভেট পড়াতে হবে না। আমি একাই যা
পারবো তাই পড়বো।
বাবা ভল্ল: স্কুলে ভর্তি হলে ক্ষেতে কাজ করবে
কে?
আমি: বাবা আমি কাজ করবো। আমি তো আর
স্কুলে প্রতিদিন যাবো না।
বাবা: আচ্ছা ঠিক আছে।
এরপর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক রফিক স্যারের
সহায়তায় আমি হাই স্কুলে ভর্তি হলাম।
কিন্তু, ছাত্র হিসেবে ভালো থাকায় রফিক স্যার আমায় খুব
ভালোবাসতেন। অনেক উপকার করেছেন।
আমাকে তিনি বলেছিলেন যে লেখাপড়া না ছাড়তে।
তাই আমি লেখাপড়া ছাড়িনি।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাজে যাই । পরে স্কুলের সময়
হলে স্কুলে যাই। ছুটির পর আবার মাঠে কাজ করতে
চলে যাই। আর মাসের বেশির ভাগ দিনই স্কুলে
যাওয়া হতো না। এভাবেই আমার দিন চলতে থাকে।
আসলে সবার ভাগ্য এক হয় না।
কিন্তু, কারো কাছে সেটা এতটাই নিষ্ঠুর যে তার জীবনের
সকল সুখ কেরে নেয়।
যখন আমার অন্যান্য ছেলেদের সাথে মাঠে খেলার
কথা তখন আমি ক্ষেতে কাজ করি।
এটাই ভাগ্য।
কিন্তু এভাবে চলতে চলতে জে এস সি পরিক্ষা চলে আসল।
আসলে কিন্তু স্কুল ঠিক মতো করতে পারতাম না তাই
রেজাল্ট ও তেমন ভালো হলো না। তবুও যা
করেছিলাম তা আমার পক্ষে যথেষ্ট ছিলো ।আমি
GPA 4. 38 পেয়েছিলাম।কবুও আমি খুশি। কারন
আমি কোন কোচিং না করে, নিয়মিত স্কুলে না এসেও এই
রেজাল্ট ই অনেক।
এরপর যখন এসএসসি। তখন কাজের চাপে পড়াশুনা
তেমন হতো না। তবুও সারাদিন কাজ করে রাতে
অনেক পড়তাম।
কিন্তু পরিক্ষা দেওয়ার জন্য ফর্ম পুরন সহ প্রায় তিন
হাজার টাকার দরকার। কিন্তু এতটাকা এতো কম
সময়ে কোথায় পাবো?
তাই মানুষের বাসায় কাজ করতে শুরু করলাম।
কিন্তু তারপবে ও হলো না তাই রফিক স্যারের কাছে
গেলাম। উনি আমাকে কোনো কথা না বলেই টাকা
দিয়ে দিলেন। আসলে রফিক স্যারের কাছে আমি চির
কৃতগ্গ।
আজ ও উনি আমায় বাচালেন।
আর যাই হোক একটু বেশি পরিশ্রম করায় রেজাল্ট ও
ভালো হলো।
কিন্তু বাবা আমায় আর পড়াতে চাননা।
বাবা বললেন: সিয়াম, বাবা তোকে আর পড়তে হবে না।
কলেজে পড়ার অনেক খরচ। ওগুলো কিভাবে দিবি?
সুন তাই বলছি তোকে আর পড়ালেখা করতে হবে না।
আমি: বাবা তুমি ভেবনা। দেখ এতোদিন যখন
পেরেছি। এখনো পারবো। তুমি দেখো,,,,,
এসএসসি পরিক্ষার পর রেজাল্ট এর আগে তিন
মাসে কাজ করে অনেক টাকা পাইছিলাম। যার কিছুটা
বাড়িতে দিয়ে বাকিটা রেখে দিয়েছিলাম। তাই ওটা
দিয়ে ভর্তি হলাম আর কিছু বই কিনলাম। তার পর
ঠিক আগের মতো করে আবার বাসায় কাজ করতাম আর
কলেজে যেতাম।
কলেজে নিয়মিত গেলেও প্রাইভেট পড়তাম না।
কারন আমার সাধ্য ছিলোনা।
যখন সেকেন্ডইয়ারে উঠলাম তখন একটা পার্টটাইম
জব পেয়ে গেলাম। যা তখন আমার খুবই দরকার
ছিলো। বেতন ও মোটামুটি ভালো। তাই বড় ভাইকে
কৃষি কাজের দায়িত্ব দিয়ে আমি পার্টটাইম জব
করতে শুরু করলাম।
সকালে কলেজ করে বিকালে কাজে যেতাম।
বেশ ভালোই কাটছিলো দিন। পরিবারের অভাব
কিছুটা হলেও কমে গেছে।
তারপরে একদিন কলেজের সিড়ি দিয়ে উপরে উঠার সময় খুব
জোরে ধাক্কা খেয়ে পরে গেলাম।
তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে
আছে।
আমি মেয়েটির থেকে মাফ চাইলাম কারন ভুলটা
আমারই। বইয়ের দিকে তাকিয়ে হাটছিলাম তো তাই
দেখতে পাইনি।
কিন্তু মেয়েটি কিছুই বললনা। বরং হা করে তাকিয়ে
আছে। আমি আর কিছু না বলেই চলে আসলাম।
আসলে আমি তাকে চিনিও না। হয়তো নতুন এসেছে।
একদিন কলেজ শেষে বাসায় যাওয়ার সময় আবার
মেয়েটির সাথে দেখা। মেয়েটি আমার পথ আটকিয়ে
বলল,
মেয়েটি: আপনার নাম কি?
আমি: জ্বি, সিয়াম.।
মেয়েটি: আমি মেধা,এখানে নতুন এসেছি। আমার
বাবা এখানকার এনজিও চাকরি করেন। । আর
আপনাকে দেখে মনে হলো আপনি সবার থেকে একটু আলাদা
তাই আপনার সাথে বন্ধুত্ব করতে এসেছি
আমি: আসলে আমি দ:খিত।আমি আপনার সাথে
বন্ধুত্ব করতে পারব না।
মেধা;: কিন্তু কেন?
আমি:: দেখুন এর অনেক কারন আছে।
মেধা:: আমি জানতে চাই।
আমি:: ঠিক আছে শোনেন, বন্ধু হতে হলে প্রথমত
বন্ধুকে সময় দিতে হয় কিন্তু আমি দিতে পারব না ।
আবার বন্ধুত্ব করতে গেলে বন্ধুদের ট্রিট দিতে
হয় তা তো আমার পক্ষে অসম্ভব। আরও অনেক
কিছু। তাই আই অ্যাম সরি।
মেধা আর কিছু বললনা। আমি চলে আসলাম
আসলে আমার কোনো বন্ধু নেই। কারন তো
বললামই।
আর যাই হোক পরদিন বিকেলে কাজে যাচ্ছি ঠিক তখনই
রাস্তায় আবার মেধার সাথে দেখা,,, কিন্তু, আমি
পাশকাটিয়ে যেতেই ও আমাকে বলল,
মেধা:: শোনো আমাকে বেশি সময় দিতে হবে না শুধু
বন্ধুত্ব হলেই চলবে।!!!
আমি: তুমি কি ভেবে বলছ?
মেধা:: হুম...
আমি: ঠিক আছে,,,,,,
এরপর থেকে ওর সাথে প্রায় কথা হতো।
একদিন ও বললো,
মেধা:: আচ্ছা, তুমি এমন কেনো।? কারো সাথে বেশি
কথা বলনা?
আমি: আর, তুমি যেহেতু আমার বন্ধু তাই বলাই যায়।
আসলে আমার জীবন সবার থেকে আলাদা। এই যে
এতোদুর পর্যন্ত এসেছি সব আমার নিজের
চেষ্টায়,,, এভাবে সব কথা ওকে খুলে বললাম।
কিন্তু, ও কথাগুলো শুনছে আর আমার দিকে অবাক হয়ে
তাকিয়ে আছে।
কিন্তু, কথাগুলো বলার পর ওর চোখে পানি দেখতে পেলাম।
কিন্তু, সেদিনের পর থেকে ও আমাকে বন্ধু হিসাবে আরও
বেশি কেয়ার করতে শুরু করলো।প্রতিদিন আমাকে
ফোন করতো। খোজখবর রাখতো।
কিন্তু, কেন যে জানিনা আমারও মনে হতে লাগলো যে ও আমার
খুব কাছের কেউ। যাই হোক
তারপর আসলো এইস এস সি পরিক্ষা।
প্রিপারেশন ভালো থাকায় রেজাল্ট ও ভালো হলো।
যখন অনার্সে তখন কাজের পাশাপাশি টিউশানি
করাতে লাগলাম। দিনগলো ভালোই কাটতে লাগলো।
তারপর, বড় ভাই কিছু জমি বিক্রি করে একটা ফার্ম খুলল।
কিন্তু, এদিকে আমার টাকা আর ভাইয়ের টাকা সব দিয়ে
সংসার চালাতে লাগলাম। যার জন্য পরিবারে
সচ্ছলতা আসতে শুরু করলো ।এভাবে আমি অনার্স
ফাইনাল ইয়ারে,
একদিন টিউশনিতে যাওয়ার পথে মেধার সাথে দেখা।
ওকে কিছুটা বিচলিত দেখাচ্ছিল।
তাই আমি বললাম,,,
আমি: কি ব্যাপার মেধা তোমায় এমন দেখাচ্ছে
কেন? কিছু হয়েছে?
মেধা:: বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে সিয়াম।
আমি:: এতো খুশির খবর,!
মেধা:: কিহ্! এটা খুশির খবর?
আমি: হুম্, বন্ধু হিসাবে দাওয়াত দিবে তো?
মেধা::( আমার কলার চেপে ধরে) ওই তোর দাওয়াত
লাগবে তাই না! ওই তুই এমন ক্যান?
তুই কিছু বুঝিস না?
আমি:: এই কি করছ। এমন করছো কেনো? আর তুই
তুকারি করছো কেনো?আবার আমি কি বুঝবো???
মেধা:: তুই কিছু বুঝিস না তাইনা? দারা,,
কিছু বুঝে ঊঠার আগেই
আমার ঠোটে.........
এবার বুঝলি? আমি তোকে ভালোবাসি! সেই প্রথম
যেদিন দেখেছিলাম সেদিনই ভালো লেগে গেছিলো।
তারপর তোর সম্পর্কে জেনে সেটা ভালোবাসায়
পরিনত হয়ে গেছে!! আমি বিয়ে করলে শুধু তোকেই
করবো আর কাউকে না।
আমি::(নিজের কানকে বিস্বাস করতে পারছিনা)
বুঝতে পারছিনা কি করব।
চুপ করে দাড়িয়ে আছি।
মেধা:: কিছু তো বল? আমি কি করবো?
আমি::( নিজেকে সামলে নিয়ে) তুমি আমাকে ভুলে
যাও মেধা। আমাকে ভালোবাসলে তুমি সুখী হতে
পারবে না। আমার তেমন কিছুই নেই।
মেধা:: আমার কিছুই লাগবে না শুধু তোমাকে চাই
বলেই কাদতে শুরু করলো...
আমি:: তুমি পারবে আমার সাথে মানিয়ে নিতে?
মেধা:: হুম্ পারবো।
আমি:: ঠিক আছে। কিন্তু তোমাকে দেরি করতে হবে।
আমার চাকরি না হওয়া পর্যন্ত।
মেধা:: আমি পারবো। আজই বাবাকে বলবো আমি
বিয়ে করবো না। যদি না মানে তাহলে সুইসাইডের
ভয় দেখাবো।
আমি:: ঠিক আছে তুমি যাও।
সে চলে গেলো। পরদিন ও ফোন করে,,
মেধা:: মিশন সাক্সেসফুল,,,,,!আর কোনো সমস্যা
নেই। যতদিন ইচ্ছা ততদিন আমি পড়তে পারব
আমি::সত্যিই?? আমিও খুব খুশি হলাম।
এরপর অনার্স শেষ করে একটা কম্পানিতে জব
পেয়ে গেলাম। বেতন ২৬ হাজার টাকা।
তারপর, বাবা মা আর ভাইয়া শুনে যে কতটা খুশি হয়েছেন
সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। অবশেষে পরিবারের দু: খ
শেষ হলো। এদিকে ভাইয়ের খামারের ও বেশ উন্নতি
হয়েছে।
৪ মাস পর আজ আমাদের ছোট বোনের বিয়ে। খুব
ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল। মা বাবা খুব খুশি। আর
আমাদের দুখ নেই। ৫ মাস পর
আজ আমার বড় ভাইয়ের বিয়ে।সেই সাথে
আমার আর মেধারও বিয়ে।
বাড়িতে একসাথে দুটো বিয়ে হচ্ছে। তাই মেহমানে
বাড়ি ভরপুর।
,
,
বাসরঘরে মেধা ঘোমটা দিয়ে বসে আছে।
আমি ঢুকতেই ও এসে আমাকে সালাম করলো।
এরপর খাটে গিয়ে বসলো। আমি ওর কাছে গিয়ে
বসতেই ও আমার গলা জড়িয়ে ধরে বললো,,
এতোদিন অনেক কষ্ট করছো এবার একটু.....
যাই হোক বাকিটা ইতিহাস..........
,
,
মানুষের জীবন অনেক কঠিন। অনেকেই প্রতিকুল
পরিবেশে ভেঙ্গে পরে। এটা ঠিক নয়। জীবনে কিছু
করতে চাইলে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। তবেই
সফলতা আসবে।
,
,
,
বি: দ্র: ভুল ত্রুটি হলে ছোট ভাই মনে করে ক্ষমা
করে দিবেন। আর যদি ভলো লাগে একটু কমেন্টে
জানাবেন,, যদি খারাপ লাগে সেটাও জানাবেন।
Post a Comment