সারাদিন শুধু অফিস, অফিস আর অফিস।
এই, তোর ইচ্ছে করে না আমাকে সময় দিতে? তাহলে ভালোবাসলি কেন?
আমাকে বিয়ে করলি কেন?’
চোখজোড়া আগুনের মত হয়ে আছে নীলার।
বউ-এর কাছে এমন ব্যাবহার সবসময়ই প্রত্যাশিত নয়নের। ভালোবাসার প্রকাশ হয় এতে। মোজাইক করা ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে নয়ন, নিশ্চুপ। বউ-এর মেজাজ এখন ঊনপঞ্চাশে। এই মুহূর্তে ভালো কথা বললে বউ পেয়ে বসবে। তাই প্রতিক্রিয়াটা হওয়া চাই বিপরীত।
মনে মনে নয়নও রেগে আছে।
বউটা একদম বে-আক্কেল।
স্বামী এত গরমের মধ্যে জ্যাম ঠেলে
অফিস সেরে বাসায় এসেছে,
কোথায় স্বামীকে একটু আদর
করাবে ঠাণ্ডা শরবত বানিয়ে দেবে, তা না উল্টো ঝাড়ি!
-জানো নীলা, আজ কি হয়েছে?
-চুপ কোনো কথা না।
-একটা মেয়ে....
'একটা মেয়ে' কথাটা শুনে নয়নের দিকে
ফিরে তাকায় নীলা।
'কি হয়েছে একটা মেয়ে?'
কলার চেপে ধরে সে।
-বাসে একটা মেয়ে আমার দিকে
তাকিয়ে ছিল।
-ও, আচ্ছা তুমি ওমনি মজনু হয়ে গেছিস তাই না? দাড়া মজা দেখাচ্ছি।
-কি মজা?
-তোর আজ ভাত বন্ধ। যা গিয়ে গোসল কর।
.
বাড়ন্ত ভুড়িটা একটু আগে চলছে নয়নের।
আর নয়ন ভুড়ির ঠিক পিছনে।
এক মাত্র ছেলে এসে জাপটে ধরে নয়নকে।
-আব্বু তোমার পেট এত মোটা কেন?
-জানিনা আব্বু।
-তুমি কি মহিলা?
-মহিলাদের পেট মোটা হয়?
-জি, আম্মুরও তো ছিল, যখন আমি আকাশে ছিলাম।
নয়ন থতমত খেয়ে যায়। ছয়বছর বয়সী ছেলে এত কিছু জানে কিভাবে?
-তোমাকে এসব কে বললো?
-কেন কাল তুমিই তো ছবি দেখিয়ে বলেছো।
-কি বলেছি?
-একটা ছবিতে আম্মু মোটা ছিল তখন
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম এ ছবিটা কার? তখনই তো তুমি বললা।
.
নয়ন সাহেব জিহ্বার আগায় কামড় বসিয়ে দেন। ছেলেটা এরকম ইচড়েপাকা হবে এটা ভাবা যায় না ।
চলো বাবা, আজ আবার ছবি দেখবো।
ঈশান সাহেব বললেন তার ছেলেকে।
.
ছবি দেখানোর এক পর্যায়ে নয়ন সাহেবের ছেলে তাকে জিজ্ঞেস করলো..
— আব্বু এই
ছেলেটা আর এই মেয়েটা কে?
নয়ন সাহেব উত্তর দিলেন...
—এরা তোমার আব্বু আম্মু।
পিচ্চি ছেলে মাথায় হাত দিয়ে বললো,
—আমার আব্বু আম্মু এত ছোট!
তাহলে তোমরা কারা?
নয়ন সাহেব একটু লজ্জা পেয়ে বললেন,
— এটা আমাদের ছোট কালের ছবি
তার ইঁচড়েপাকা ছেলে মাথায় হাত
দিয়ে বললো...
— তোমরা এত ছোট বয়সে বিয়ে করেছিলে! আব্বু আমিও করবো
।
.
ওয়ারড্রব এর কোনা ঘেসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শাড়ির কোণা পেচাতে পেচাতে এসব দেখছিল নীলা। অবস্থা এখন বড়ই বেগতিক। এই ছেলে বাবা মার মান সম্মান শেষ করে দিবে।
নীলার মুচকি হাসিটা কানা চোখে দেখছিল নয়ন। খুব শান্তি পায় সে। নীলার হাসির মাঝে যেন স্বর্গ খুঁজে পাওয়া যায়। আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে.....দেখতে আমি পাইনি, তোমায় দেখতে আমি পাইনি..... হুম নীলার মাঝেই লুকিয়ে আছে শান্তি। ভালোবাসা আর কাছে থাকার অটুট বন্ধন।
.
.
আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা- কলেজগামী এক তরুণীকে দেখে
ভীষণ ভালো লাগে নয়নের।
কলেজ পোশাকে সব মেয়েকে ভালো
লাগে না, কিন্তু এ মেয়েটা নয়নের বুকের
ভেতরে থাকা কলিজার ভেতর তীর ছুড়ে দিয়েছে। ভাব জমায় নয়ন।
কিন্তু না, ভাব হয় না।
সুন্দরী মেয়েদের ইগো বেশি।
তবে কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধুত্ব হয়।
নয়ন সেটা চায় না। নয়ন চায় ভালোবাসতে, কাছে টানতে। কলেজ থেকে
কতদিন যে নীলার পিছু নিয়েছে
তার হিসেব নেই। কিন্তু নীলা বন্ধু ছাড়া
কিছুই ভাবে না তাকে। প্রাক্টিক্যাল খাতাও
লিখে দিতো নীলা। নয়নেকে মানসিক অনেক সাপোর্ট দিলেও তারা শুধুই বন্ধু।
না, এভাবে চলে না। নয়ন চাচ্ছে না এভাবে।
-দেখ নীলা, তুই যদি আমাকে ভালো নাই বাসিস তাহলে প্লিজ লিভ মি...
-দেখ নয়ন আমরা বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু
-আমাকে ভালোবাসতে সমস্যা কোথায় তোর?
-আমার পরিবার....
-যদি তোর পরিবার কে রাজী করাই?
-আমি জানিনা।
-ঠিক আছে, শোন তাহলে, আজ থেকে এই মুহূর্ত থেকে আমাদের সব কিছু শেষ!
.
নীলা ধীর পায়ে নয়নের থেকে দূরে সরে যায়। এক দিন, দুই দিন যায়। নীলার মন আর মানছে না। সে তার অজান্তেই নয়নের হয়ে গেছে।
কিন্তু প্রতিটা মেয়ের কাছেই তার
পরিবার আগে। কখনোই চাইবে না
পরিবার কষ্ট পাক....
নাহ...নয়নকে চাই।
.
কলেজের শেষ দিন আজ।
এর পর কে কোথায় যায় তার
কোনো ঠিক নেই। নয়নকে খুঁজছে নীলা।
পাচ্ছে না। কোথাও পাচ্ছে না।
কোনো জায়গায় নেই সে।
সেদিন তো পেলোই না,এর পরের
তিন বছরেও নয়নকে পেলো না নীলা।
হটাৎ একদিন নয়ন তার বাসায়।
নয়ন ভালো জায়গায় পড়ে,ভবিষ্যত
উজ্জল। এখন নিশ্চয় নীলার আর
আপত্তি নেই...কিছু শোনার আগেই
নয়নের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে নীলা। সবার সামনে। হাত দিয়ে মারতে থাকে তাকে...
'তুই আমাকে ছেড়ে চলে গেছিলি,তুই
জানিস না ভালোবাসি তোকে আমি। '
ছেলেটাও আবেগী হয়ে পড়ে। সবার সামনেই শক্ত করে ধরে মেয়েটা কে। কিছু বছর পর পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হয় তাদের।
সংসার আলো করে আসে ছোট্ট একটা ছেলে। তবে তারা এখনো একে অপরকে তুই করে বলে। নীলার নির্দেশ এটা। বিয়ের পর এটা নীলার প্রথম চাওয়া ছিল। দরজায় খিল দিয়ে নয়ন যখন রূমে ঢুকলো নীলা সরে গিয়ে এই
কথাটাই বলেছিল..
..
-এই শোন, আমি আগে তোর বন্ধু পরে বউ।
যদি কখনো বউ হিসেবে আমার
কাছে কিছু লুকাতে চাস তাহলে বন্ধু নীলাকে বলবি। নইলে তোর খবর আছে।
নয়ন হাসে। তারো ইচ্ছে করে রবি
ছিক আছে, ঠাকুরের মতো বলতে, 'আমি পাইলাম, ইহারে আমি পাইলাম, সে আমার সম্পত্তি নয় সে আমার সম্পদ'
.
আর এভাবেই শুরু হয় দুটো মনের
লুকানো স্বপ্ন যাত্রা।
এভাবেই আজ তারা দুজন দুজনের।
একটি বিশেষ দিন কিছুক্ষণ পরই।
নীলা মনে মনে ক্ষেপছিল। এই ছেলেটা ভুলে গেছে এই দিনটাকে। কিছুই আনলো না। হাতে করে একটা তরমুজ এনেছে। কিপ্টা কোথাকার.....
রাত দশটা। নীলা ডাইনিং সাজায়।
পিতা, পুত্র খেতে আসে। নীলাও খায়।
নীলা বারবার নয়নের দিকে তাকাচ্ছিল।
তার চোখে মুখে আজকের দিনের অনুভুতির ছিটেফোঁটা ও নেই। খাওয়া শেষে নীলা কঠিন গলায় বললো....
—তরমুজ কাটবো?'
বাম পাশের দাঁত দিয়ে ভাত
চিবুতে চিবুতে নিষেধ করল নয়ন।
.
রাত বারোটা। ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে।
ড্রয়িং রুমে টিভি দেখছিল নীা। নয়ম ডেকে বললো, 'নীলা তরমুজ খাবো, গরম পড়েছে খুব'
তরমুজ কাটতে যেয়ে নীলা প্রচণ্ড রকম শক খেলো। তরমুজের ভেতর এটা কি? দেখো, হাত দিয়ে ধরতেই টোন দিলো, 'হ্যাপি সেভেন্থ এনিভার্সারি।'
নীলা এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। ভেতরে একটা লাল খামও আছে।
ভিজে গেছে তরমুজের রসে। নীলা খুলে দেখে। 'একটু ছাদে আসবা?' লিখাটা দেখেই নীলা দৌড় দিয়ে ছাদে উঠে।
একটা পাঞ্জাবি পরে আছে নয়ন। নীলা ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে যায়।
-কি ভেবেছিলে? আমি ভুলে যাবো?
-তুই একটা শয়তান...এত ভালোবাসিস কেন আমায়?
ইমোশনাল হয়ে যায় । নীলা কেদে দিচ্ছে। নয়নের বুকে মাথা রাখে। নয়ন তার একটা হাত চেপে ধরে। নীলা আরো আবেগী হয়ে যাচ্ছে। রাতের আকাশে একটুও মেঘ নেই। আকাশের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে একটা নৌকা ভাসছে। অর্ধ চাদ! আজ তাদের পূর্ণিমা রাত! অর্ধ না, পূর্ণ পূর্ণিমা আর পূর্ণ ভালোবাসা....
পেছনে বোমা ফোটার মত কয়েকটা বেলুন ফোটার আওয়াজ আর পার্টি স্প্রে নীলা আর নয়নকে এলোমেলো করে দিলো।
'হ্যাপি সেভেন্থ এনিভার্সারি টু মাই প্যারেন্টস'
ছোট্ট ছেলেটা হাসতে হাসতে বললো।
বাবা মা দুজনই ছেলেটাকে কাছে টেনে নিল। এক সাথে চাদের আলো দেখছে সবাই।
আর চাঁদ পলকহীন ভাবে দেখছে ওদেরকে.....
Post a Comment