ভালোবাসা তোমাকে দিলাম ছুটি,প্রথম পর্ব,Bhalobasa
বাবা হাসপাতালে ভর্তি । বাড়িতে আছোই  শুধু মা আর ছোট বোন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি বাবা। বাবা অসুস্থ হয়ে যাওয়াতে নিদারুণ সংকটের মধ্য দিয়ে এখনকার সময়টা অতিবাহিত হচ্ছে। আমিও তেমন কিছু করতে পারছিনা। সুদু  মাত্র অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। তারপর ও চাকরীর জন্য এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছি। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে ও যেখানে হাজার হাজার তরুন চাকরীর জন্য হন্য হয়ে ঘুরছে, পাচ্ছে না। সেখানে অনার্সে পড়া অবস্থাতেই আমার চাকরী পাওয়াটা অনেক, টা কঠিন ব্যাপার । তারপর ও চেষ্টা করে যাচ্ছি, যদি কোনমতে একটা চাকরী পেয়ে যাই ।

এদিকে ছোট বোন সেদিন দেখলাম আম্মুর সাথে বলছে, কলেজের তিন মাসের বেতন বাকি পরে আছে, সামনে ওর পরীক্ষা । কলেজ থেকে নোটিশ দিয়েছে পরীক্ষার আগে দিতে হবে।

আমার পকেটে তখন দু টাকা ছিলো । এসব শোনার পর বাসা থেকে বেরিয়ে যাই। বেরোতেই সামনে একটা আট-দশ বছরের ছেলেকে দেখলাম ছোট্র একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । হাটা দিয়ে একটু কাছে গেলাম। ছেলেটা দেখলাম তখনো কেঁদে যাচ্ছে । বাসার সামনের এই রাস্তাটায় যে ছেলেটাকে আমি নতুন দেখছি তা নয় । সেই ছোট থেকেই তাকে এখানে দেখে আসছি, তবে তখন সাথে তার মা ছিলো । আজ শুধু ছেলেটাকে, আর তার কোলে ছোট একটা বাচ্চা দেখছি । ছেলেটার নাম আমি জানি না। তবে তাকে আমি সংগ্রাম সাহেব বলেই ডাকি। এই নামে ডাকার পেছনে ও একটা গল্প আছে । থাক, সেটা অন্য কোন একদিন বলবো। থাকনা একটু রহস্য।

কাছে গিয়ে সংগ্রাম কে কাদার কারণ জিজ্ঞেস করতেই, আমার নিজের ও কেঁদে ফেলার উপক্রম হলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, চল সংগ্রাম সামনের ওই দোকানটায় তোকে নিয়ে ভালো কিছু খাওয়া যাক । ছেলেটে দুদিন না খেয়ে আছে, পানি ছাড়া তার নিজের পেটে তেমন কিছুই পরে নি। বাসায় বাসায় গিয়ে অনুনয়-বিনয় করে ছোট বোনের জন্য সামান্য কিছু খাবার পেয়েছে। সংগ্রামের কোলের মেয়েটা তার বোন। বয়স এক বছরের চেয়ে একটু বেশি হবে।

পকেটে দু টাকা নিয়ে, সাথে সংগ্রাম কে ভালো খাবার খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে..উন্নতমানের একটা রেস্টুরেন্ট এর ভেতরে যখনি চেয়ারে বসতে যাবো; ঠিক তখনি পেছনের টেবিলটায় আমার চোখ পড়লো। দেখলাম মিরা বসে আছে । মিরার সাথে আমার পরিচয়টা দীর্ঘদিনের। অনেকদিন পর দেখা, স্বাভাবিক ভাবেই ওর সাথে একটু কথা বলতে মন চাচ্ছিলো ! মনের তীব্র ইচ্ছাটাকে বাদ দিয়ে, সংগ্রামকে নিয়ে পাশের টেবিলটায় বসলাম। মিরা সম্ভবত আমাকে দেখতে পায়নি। দেখতে পেলে কথা বলার জন্য ঠিকই ছুটে আসতো।

দোকানের একজনকে ডাক দিয়ে বললাম, ভাই ভালো কিছু খাবার দিন। লোকটা আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে খাবার আনতে গেলো । আমি বসে ভাবতে লাগলাম পকেটে আছে মাত্র দু টাকা, খাবার খাওয়ার পর বিল একশ টাকার নিচে আসবে বলে মনে হয়না । টাকা কোত্থেকে দিবো ভাবছি, ঠিক তখনি মিরা সামনে দাঁড়ালো। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আমি একবার তাকিয়ে, চোখ সড়িয়ে নিলাম । আমার পাশেই এসে বসলো । আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি।

- কেমন আছো মাসুদ ?

- আলহামদুলিল্লাহ্‌, ভালো আছি । তুমি ভালো আছো ?

- হ্যা, খুব ভালো আছি । তা আজকাল কি করছো? কোথায় আছো ? সেদিন তোমার মেসে গিয়েছিলাম, কিন্তু তুমি নেই, একজন বললো তুমি নাকি মেস ছেড়ে চলে গেছো ! কি হয়েছে বলবে কি ?

- চাকরীর জন্য ঘুরছি, হ্যা ; আগের মেস ছেড়ে দিয়েছি । এখন এক আত্মীয়ের বাসায় আছি । কিছু হয়নি মিরা, বাবা-মা-বোন নিয়ে এইতো বেশ আছি। তুমি কি করছো ?

- আমি লেখাপড়া ছাড়া আপাতত কিছুই করছিনা। তোমার চেহারায় হতাশার ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ! কোন সমস্যা ?

- আমার কিছু টাকা লাগবে মিরা । দিতে পারবে ?

- অবশ্যই ! আচ্ছা তুমি টাকা চেয়েছো আমি দিবো না সেটা ভাবলে কি করে ! বলো কত টাকা দরকার ?

- দুশো টাকা দাও । পরে দিয়ে দিবো।

- দুশো টাকা! কি করবে? আচ্ছা তোমার পাশে বসে থাকা ছেলেটাকে কিছু খাওয়ানোর জন্য এখানে নিয়ে এসেছো, আর তোমার পকেটে টাকা নেই ! তাইনা ?

- হ্যা, ঠিক ধরছো। টাকা নেই বললে ভূল হবে, দু টাকা আছে ।

- তুমি যা খাওয়ার খাও, বিল যা আসে আমি দিবো। টাকা নিয়ে তুমি চিন্তা করো না।

- আচ্ছা।

দুশো আশি টাকা বিল দিয়ে বাইরে রাস্তার ধারে এসে দাঁড়ালাম। মিরা ও একটু পরে আমার পাশাপাশি এসে দাড়ালো।

- মিরা আরেকটা উপকার করতে পারবে ?

- বলো, এবার কার জন্য কি করতে হবে। নিজের জন্য তো তুমি আমার কাছে কখনো কোন সাহায্য চাওনি। আজ ও যে চাইবে সেটা ও বলছিনা।

- একটা দুধের প্যাকেট কিনে দিতে পারবে ?

- চলো । ওই দোকানটায় যাই ।

আড়াইশো টাকা দিয়ে একটা দুধের প্যাকেট কিনে সংগ্রামের হাতে দিয়ে বললাম, যা ব্যাটা। আর কাঁদবি না । এই প্যাকেট দিয়ে, তোর বোনকে কয়েকদিন খাওয়াতে পারবি ।

সংগ্রাম চলে গেলো । আমি মিরাকে উদ্দেশ্য করে যখনি কিছু বলতে যাবো, আমাকে চুপ থাকার ইঙ্গিত দিয়ে আমার হাতটা টান দিয়ে, হাতের মুঠোয় কিছু টাকা ধরিয়ে দিলো।

- মাসুদ, এখানে কিছু টাকা আছে । রেখে দাও। তোমার কাজে লাগবে।
আমি উত্তরে বললাম, 'চলো তোমাকে বাসায় পৌছে দেই' ! মিরা একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে মনে হচ্ছে। আমি যে তাকে বাসায় পৌছে দেয়ার কথা বলেছি সেটা সে বিশ্বাস করতে পারছেনা, আবার পারছে !

- চলো ।

মিরাদের বাসার সামনে আসতেই মিরা থমকে দাঁড়ালো। এবার আমি ওর দিকে একটু তাকালাম। বহু পরিচিত মানুষটাকে বহুদিন পর এতো কাছ থেকে দেখছি । বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা ঠিক হবে না । আমি চোখ সড়িয়ে নিলাম। কেনো জানি মনে হচ্ছে মিরা কিছু বলতে চাচ্ছে। আমি সামনের দিকে পা বাড়াতেই মিরা ডাক দিলো ! অনেক দিন পর কারো মায়া মাখানো ডাক শুনতে পেলাম !

- মিরা কিছু বলবে ?

- য়েহ না মানে, তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো। শুনবে একটু ?

- না, শুনতে ইচ্ছে করছে না । বাসায় যাও । আমি গেলাম। আল্লাহ্‌ হাফেজ।

মিরাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি সামনে পা বাড়ালাম। একটু এগিয়ে গিয়ে, আবার একটু পেছনে তাকালাম। মিরা এখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ।

তারপর আমি এবার আরেকটু দ্রুত গতিতে সামনে পা বাড়ালাম।

ফোন বাজছে । আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। টেবিলের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে রিসিভ করতেই মিরার কন্ঠ শুনতে পেলাম !

- হ্যালো, মাসুদ ভালো আছো ?

- আলহামদুলিল্লাহ্‌, ভালো। তুমি ভালো আছো ?

- হ্যা, ভালো । কি করছো এখন ?

- তেমন কিছু না । শুয়ে ছিলাম,তুমি ফোন দেয়াতে বিছানা থেকে ওঠে ফোন রিসিভ করলাম।

- তোমার কি শরীর খারাপ ? কথা কেমন যেনো শোনাচ্ছে !

- না মিরা, শরীর ভালো । কিছু হয়নি।

- আচ্ছা, ভালো। তুমি কি আগামীকাল ক্যাম্পাসের গেইটের বাইরে আমার সাথে দেখা করতে পারবে ?

-হুম আচ্ছা , আমি দুটার দিকে চলে আসবো ।

- আচ্ছা, ঠিক আছে। রাখি এখন, ভালো থেকো ।

মিরা ফোন রাখার আগেই আমি রেখে দিলাম । স্কুলজীবনে মিরার সাথে পড়াকালীন সময় থেকে আমি ওকে পছন্দ করতাম কিন্তু । সে বিষয়টা সে প্রথমে জানতো না । আমি যে ওকে পছন্দ করতাম, তবে ওকে দেখে যে জীবনের প্রথম প্রেমের অনুভূতি মনের মধ্যে অনুভূত হয়েছিল সেটা আর কেউই জানতো না ! স্কুলজীবনে মিরা বাদে প্রায় সবার সাথেই টুকটাক কথা হতো, বেশিরভাগই ছিলো পড়ালেখা বিষয়ক। কিন্তু মিরার সাথে পড়ালেখা বিষয়ক কোন কথাও পর্যন্ত বলতাম না ! কিন্তু প্রচন্ড জড়তা থাকার কারনে ওর সাথে আমার কথা হতো না ! জড়তাটা শুধু ওর ক্ষেত্রেই কাজ করতো বেশি! জীবনের প্রথম প্রেমের অনুভূতি ছিলো মিরা, সেজন্যই বোধহয় তাকে দেখে স্বাভাবিক ভাবেই জড়তাটা অনেকটা বেশি কাজ করতো । তবে দূর থেকে বিভিন্ন ভাবে মিরাকে কিছু একটা বোঝাতে চেষ্টা করতাম। তারপর স্কুলের শার্টের হাতা গুটিয়ে, হোল্ড করে...একটুখানি ভালোভাবে নিজেকে মিরার সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা চালাতাম ! জানিনা সে তখন এসব খেয়াল করতো কিনা, তবে আমি দিনের পর দিন আরো অদ্ভুতভাবে ও নিজেকে দূর থেকেও ওর সামনে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করতাম। স্কুল ছুটির পর, ওকে একটু দেখার জন্য গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে দাকতাম পায়চারী করা বিকেল গুলিকে মনে হতো পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম সময় ! অনেক  অপেক্ষার পর যখন একদল ইউনিফর্ম পড়া মেয়েকে আসতে দেখতাম, বাইরে থেকেই দেয়ালের পাশে লুকিয়ে একই ইউনিফর্ম পড়া একদল মেয়ের মাঝে মিরাকে খুঁজে বেড়াতাম ! গেইটের সামনে আসতেই 'মিরা দেখে ফেলবে' এই ভয়ে অনেকটা আড়ালে চলে যেতাম ! আমার প্রিয় মুখটাকে দুটা মিনিট দেখার জন্য, ক্লাস পিরিয়ড মিস দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গেইটের বাইরে অপেক্ষা করার মূহুর্তগুলো, আজ.. এতবছর পরও আমার কাছে অমূল্য !হুম কিন্তু সেই তিন শব্দের কথাটি বলা হয়নি কখনো ! স্কুলজীবনটা এভাবেই কেটে গেলো। কলেজ লাইফটাতে ও মিরাকে প্রায় সবসময়ই আড়াল থেকে এভাবে দেখে কাটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু বলা হয়নি কোনো অনুভূতির কথা। মিরা এখনো এই ব্যাপারে কিছু জানে না ! কিন্তু যদি জেনে ও থাকে সেটা আমাকে বুঝতে দিচ্ছে নাহ !.. এসব ভাবতে ভাবতে আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে চলে গেলাম ।

অনেকদিন স্বপ্ন দেখা হয়না !

সকালে ঘুম ভাঙলো কারো কান্নার শব্দ শুনে !তখন  আমি অনেকটা থতমত খেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে মায়ের রুমে যেতেই দেখলাম এক জটলা মানুষ মায়ের বিছানার চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ! আমি একটু কাছে গেলাম । মায়ের নিথর, নিস্তব্ধ দেহটার পাশে বসলাম। ছোটবোন কাঁদতে কাঁদতে প্রায় বেহুঁশ হবার মতো অবস্থায় ! আমি চোখ বুঝে মায়ের কপালে হাত রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস দিয়ে সবাইকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বললাম। সবাই বেরিয়ে গেলো । আজ এতো বড় হয়ে যাওয়ার পরও যে মানুষটা রোজ রোজ আমাকে মুখে তুলে নিজ হাতে খাইয়ে দিতো, তারপর কিছুক্ষণ পর পর আমার রুমে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতো 'বাবা, তুই চিন্তা করিস না, তোর বাবা ঠিক হয়ে যাবে.. তুই বালোবাভে মন দিয়ে লেখাপড়া কর'.... সেই মানুষটা আর নেই ! আমি নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। চোখে পানি আসার উপক্রম হলেও, আসতে দিলাম নাহ!

মায়ের কোন রোগ ছিলোনা । হয়তো এই পরিবার, বাবার অসুস্থতা এইসব চিন্তা করতে করতেই...!!

সবকিছু খুব দ্রুত হয়ে গেলো ! দুপুর দুটার মধ্যেই জানাজা হয়ে গেলো... কবরস্থানে মায়ের মৃতদেহ দাফন করে দুপুর তিনটার দিকে বাসায় ফিরলাম। ছোটবোন আমার রুমে বসে কাঁদছে । আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম, ওকে কোন প্রকার শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলাম না। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে আমি আবার বাসার বাইরে বেরিয়ে এলাম। বাসার বাইরে আজ সংগ্রাম কে দেখতে পেলাম না। উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাটছি..প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো । তারপর  মিরাদের বাসার সামনে এসে কিছুটা সময়ের জন্য দাঁড়ালাম ! ওকে একটু দেখতে ইচ্ছে করছিলো ! চার মিনিটি পর মিরা নিচে নেমে আসলো । বাসার গেইট খুলে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।

- তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো মাসুদ ?

- কেমন ! না  একটু অন্ধকার তো তাই তুমি ভুল দেখছো।

এটুকু বলে আমি চশমাটা একটু ঠিক করে নিলাম । আমার চশমা পড়া শুরু সেই ক্লাস নাইন থেকে।

- আচ্ছা, চলো আমার বাসায় চলো। 



Post a Comment

Previous Post Next Post